আসন্ন নির্বাচন এবং ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা : সাকিফ শামীমের ভাবনা

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ০৯:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ

  সাকিফ শামীম:

বাংলাদেশে ২০২৬ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন উত্তাপ বাড়ছে, তখন দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক খাতও এই নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রত্যাশা ও বাস্তবতার হিসাব কষছে।

একটি স্থিতিশীল এবং স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। ব্যবসায়ীরা সব সময়ই এমন একটি পরিবেশ প্রত্যাশা করে যেখানে বিনিয়োগ নিরাপদ থাকবে, নীতিগুলো সুসংগত হবে এবং আইনের শাসন সমুন্নত থাকবে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয় হলেও, কিছু ক্ষেত্রে নীতিগত ধারাবাহিকতার অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। আসন্ন নির্বাচন এই বিষয়গুলো সুরাহার একটি বড় সুযোগ করে দিতে পারে।

ব্যবসায়ীদের মূল প্রত্যাশাগুলো হলো:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সজাগ থাকা উচিত। হরতাল, অবরোধ বা সহিংসতা অর্থনীতির গতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়। একটি শান্ত ও স্থিতিশীল পরিবেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক। এর অভাবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ উভয়ই ঝুঁকির মুখে পড়ে।

নীতিগত ধারাবাহিকতা ও স্বচ্ছতা: সরকার পরিবর্তন হলেও যেন অর্থনৈতিক নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন না আসে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে করনীতি, আমদানি-রপ্তানি নীতি এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইনগুলোতে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা উচিত। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসবে এবং ব্যবসা করা সহজ হবে। এতে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে উৎসাহিত হন।

ওয়ান স্টপ সল্যুশন এবং ডিজিটালাইজেশন: সহজভাবে বলতে গেলে, "ওয়ান স্টপ সল্যুশন ও ডিজিটালাইজেশন" মানে হলো ব্যবসা করার জন্য সরকারের কাছে যত অনুমতি বা কাগজপত্র লাগে, সেগুলো এখন আর আলাদা আলাদা অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে না। সব কাজ একটা ওয়েবসাইট বা একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই করা যাবে। এটা অনেকটা একটা "ডিজিটাল শপ" এর মতো, যেখানে আপনি ব্যবসার সব প্রয়োজন মেটাতে পারবেন। এর ফলে ব্যবসা করা অনেক সহজ হবে, সময় বাঁচবে এবং কোনো রকম ঝামেলা বা ঘুষের সুযোগ কমবে। সরকার যদি এই ব্যবস্থাটা ভালোভাবে চালু করতে পারে, তাহলে দেশি-বিদেশি সবাই বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আরও আগ্রহী হবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে ।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও তার সুফল: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনৈতিক চেহারা বদলে দিচ্ছে। এসব প্রকল্পের সুফল যাতে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় এবং ব্যবসায়ীরা এর পূর্ণ সুবিধা নিতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ শিল্প খাতের জন্য অপরিহার্য। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে (SEZ) দ্রুত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করাও জরুরি।

দক্ষ জনশক্তি ও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন: চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তরুণদের যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করা জরুরি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে, যা দেশীয় শিল্পের চাহিদা মেটাবে এবং বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াবে। শিক্ষা কারিকুলামে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।

স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: একজন স্বাস্থ্য উদ্যোক্তা হিসেবে আমি মনে করি, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক। একটি সুস্থ জাতিই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। গবেষণায় বিনিয়োগ এবং আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা গেলে দেশেই বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এবং গ্রামীণ পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধার প্রসারে জোর দিতে হবে।

সুশাসন ও জবাবদিহিতা: একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য সুশাসন অপরিহার্য। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা কমানো, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং চুক্তি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বাজার সম্প্রসারণ: একক পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পের মতো উদীয়মান খাতগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। নতুন নতুন রপ্তানি বাজার অন্বেষণ এবং শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা জরুরি।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (SME) সহায়তা: দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প । সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তি, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বাজার সংযোগ স্থাপনে SME-কে অগ্রাধিকার দিতে হবে । কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এই খাতের অবদান অনস্বীকার্য । এই খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসএমই খাতের বিকাশের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, এবং সহজলভ্য অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করা অপরিহার্য। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এসএমই-এর প্রভাব অপরিসীম, যা স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্যোক্তা তৈরি করতে সাহায্য করে। 

বাস্তবতা হলো, নির্বাচনের আগে ও পরে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যা বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দেয়। ব্যবসায়ীরা এই সময়টায় ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতি অবলম্বন করেন। এই প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দিকে মনোনিবেশ করা যেখানে সব পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আসন্ন নির্বাচন কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি দিকনির্দেশনা। আমরা প্রত্যাশা করি, নির্বাচিত সরকার এমন একটি রূপরেখা তৈরি করবে যা দেশের ব্যবসায়িক খাতকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করবে। দেশের সকল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা এই নির্বাচনকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, যেখানে একটি প্রগতিশীল ও জনবান্ধব সরকার দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।


লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।


আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই