বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এর ক্ষুদ্র সেচ উইং সারাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিউস্থ পানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করে দেশের প্রায় ৯৩% ক্ষুদ্র কৃষকদের সেচ সুবিধা দিয়ে কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে সাবলম্বী করছে। নূন্যতম ৫ বিঘা জমি রয়েছে এমন কৃষকদের ক্ষুদ্র কৃষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিএডিসি এই সেচ কার্যক্রম ১৯৬০ সাল থেকে মাত্র ১৫৫৫টি শক্তিচালিত পাম্পের মাধ্যমে আধুনিক সেচ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থার সূচনা করেছে। এই টেকসই কার্যক্রমই আজ বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজ এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রম স্মপ্রাসারনে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থা কতটা সমৃদ্ধ হয়েছে আমরা তা অনুসন্ধান করেছি। কথা বলেছি চলমপান প্রকল্প এলাকার নানা পর্যায়ের কৃষকদের সাথে। প্রকল্প এলাকার কৃষকরা জানিয়েছে- গ্রীষ্ম মৌসুমে যখন তাদের ফসলের মাঠ প্রখর রোদ্রে চৌচির হয়, তখন কিভাবে তারা বিএডিসির গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে সেচ সুবিধা পেয়েছে।
বিএডিসির সেচ সম্পর্কিত কার্যক্রম অনুসন্ধানে জানা যায়- সারা দেশে মোট আধুনিক ক্ষুদ্র সেচ সুবিধা সম্পর্কিত ৮টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পগুলো হচ্ছে- “স্মল হোল্ডার এগ্রিকালচার কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট” + বিএডিসি অঙ্গের দায়িত্বে রয়েছেন- প্রকল্পটির কমপোনেন্ট ডিরেক্টর মোঃ রেজাউর রহমান। প্রকল্পটি বিএডিসি, ডিএই, বারি, এফএও ও কৃষি বিপনণ বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন ডঃ ইমদাদুল হক। তবে বিএডিসির পক্ষ্যে এ প্রকল্পের ক্ষুদ্র সেচ এর কাজটি দেখছেন মোঃ রেজাউর রহমান। মোট ৩৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় সমৃদ্ধ- এ প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ও ২০২৬ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পটি সামগ্রিক কার্যক্রম এবং ক্ষুদ্র সেচ অংশের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে মোঃ রেজাউর রহমান বলেন- “দেশে সমৃদ্ধ কৃষি উন্নয়ন এর প্রনাঙ্গ প্রকল্প হিসেবে প্রকল্পটিকে আদর্শিক প্রকল্প বলা যেতে পারে”।
বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ এর আওতায় পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ভূউপরিউস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। প্রকল্পটি ২০১৯ সালে জুলাই মাসে শুরু হয়ে চলতি ২০২৫ সালের গত জুনে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পটি পানাসি প্রকল্প নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সাল থেকে এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পটি সুফল ছড়িয়ে পড়লে জনস্বার্থে প্রকল্পের মেয়াদ ৪ পর্যায়ে বাড়ানো হয়ে, বর্তমানে জনস্বার্থে প্রকল্পের মেয়াদ পঞ্চম পর্যায়ে বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে ক্ষুদ্র সেচ এর মাধ্যমে জমিতে প্রয়োজনীয় পানি পৌছে দিতে এটি একটি জনপ্রিয় প্রকল্প। এ প্রকল্পের বর্তমানে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন এবিএম মাহমুদ হাসান খান।
এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি ৫৩ লাখ। বিএডিসির মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পটি ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন সম্প্রসারণে বহুবিধ কর্মসূচী নিয়ে কাজ করেছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে চলতি ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কিছু কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ আলী আশরাফ। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
বিএডিসি প্রকৃত পেশাদার কৃষকদের মাঝে তাদের কৃষি জমিতে কিভাবে কখন সেচ সুবিধা, বীজবপণ অথবা কি ধরনের পরিচর্যা করবেন তা ওয়েব বেইজ কৃষি তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে “বাংলাদেশের সেচের পানি ব্যবস্থাপনা এবং ওয়েব বেইজ কৃষি তথ্য ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে পাইলট গবেষনা প্রকল্প” নামে একটি গবেষনা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রকৌশলী, কৃষিবিদ সহ সংশ্লিষ্টরা এ গবেষণা প্রকল্পে একজন পেশাদার কৃষক তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওয়েব বেইজ কৃষি তথ্য সমূহ বিশেষ অ্যাপস এর মাধ্যমে জানতে পারবেন। প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাইতে শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩ কোটি ২৪ লাখ। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মোছাঃ মাহফুজা আক্তার। বিএডিসি- “বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্প” নামে একটি ক্ষুদ্র সেচ ভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পটি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ ওয়াহিদ মুরাদ। এ প্রকল্প সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ ওয়াহিদ মুরাদ এই প্রতিনিধিকে বলেন- “প্রকল্প অঞ্চলের উপকার ভোগী কৃষকের ইতোমধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে। শুষ্ক মৌসুমে তাদের জমিতে স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা পৌছে দেয়ায় ফসল উৎপাদন বাড়ছে। ফলে প্রকল্পিিটর দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণ মূলত গণদাবীতে রূপ নিচ্ছে” এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ভূউপরিউস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প” নামে একটি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে ভূউপরিউস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সুবিধা কার্যক্রমগ ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকার কৃষকের মাঝে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ নুরুল ইসলাম। বিএডিসি পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি এবং পানি সেড নির্মানের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি ফল ও ফুল উৎপাদন প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রেখেছে। প্রকল্পটির কার্যক্রম ২০২৩ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২৮ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ মাহবুব আলম। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রমের আওতায় “সিলেট বিভাগে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবস্থা ও ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চলতি ২০২৫ সালের ১লা জানুয়ালী থেকে শুরু হওয়া ৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন প্রনজিত কুমার দে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা।
বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ উইং এর নেতৃত্বে পরিচালিত ক্ষুদ্র সেচ ভিত্তিক প্রকল্পের কার্যক্রমে স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষকেরা ইতোমধ্যে ব্যাপক সুফল পেতে শুরু করেছে। ফলে প্রকল্পগুলো পরবর্তী পর্যায়ে সম্প্রসারণের দাবী মূলত গণদাবীতে রূপ নিচ্ছে।
“দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের জন্যে অন্যতম প্রধান উপকরণ সেচের পানির উৎস্য চিহ্নিতকারন, পানির অপচয় রোধ করে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে সেচ সুবিধা পৌছে দিতে সমন্বিত সেচ ব্যবস্থাপনার সব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ফসলের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার মাধ্যমে কৃষি খাতকে লাভজনক করে এ খাতে বিনিয়োগের জন্য কৃষক ও বিনিয়োগ কারীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে”- গৃহীত প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে এমন মন্তব্য করেছেন- বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ বদিউল আলম সরকার।
বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ উইং এর সদস্য পরিচালক মোঃ ইউসুফ আলী- বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ ভিত্তিক কাজের পরিধি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই প্রতিনিধি বলেন- “কৃষি উৎপাদন আধুনিকীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সেচ কার্যক্রমে সমন্বয়, দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা, পানির অপচয় রোধ, সেচ খরচ হ্রাস ও অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে সাধারণত স্বল্প এলাকা নিয়ে সে সকল স্কীম একক ভাবে গঠিত হয় তাকেই আমরা ক্ষুদ্র সেচ হিসেবে চিহ্নিত করছি। এই ক্ষুদ্র সেচ এর সমন্বিত প্রকল্পগুলো আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আমরা ডিজেল ও বৈদ্যুতিক সেচ যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম করছি। কারণ আমাদের লক্ষ্য কৃষি সমৃদ্ধ এদেশে খাদ্য স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের এ সাফল্যকে ধরে রাখতে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছি।”
বিএডিসির ইতিবাচক কার্যক্রম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিলে বিএডিসি চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমীন খান এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এই প্রতিনিধিকে বলেন- “বাংলাদেশকে কৃষি সমৃদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে রূপ দিতেই বিএডিসি একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিবাচক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। বিএডিসি মূলত প্রধানত- ক্ষুদ্র সেচ উইং, বীজ ও উদ্যান উইং এবং সার ব্যবস্থাপনা উইং এর সমন্বয়ে অনেকগুলো বিভাগ একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন, সম্প্রসারণ বাজারজাতকরন সহ বহুবিধ বিজ্ঞান ভিত্তিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। ফলে বিএডিসি আজ একটি দক্ষ ও আদর্শ কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থাপনার একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ উইং সমন্বিত উন্নয়নের অংশ। সেচ উইং এর নেত্বত্বে গৃহীত প্রকল্প জাতীয় উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।”
বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ এর কাজের পরিধি সম্পর্কে বর্ণনা করে আমি কৃষি সচিব এর মতামত জানতে চাইলে কৃষি সচিব ডঃ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এই প্রতিনিধিকে বলেন- “কৃষি মন্ত্রণালয় এ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বহুবিধ বাস্তব ও গবেষণা ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ১৮টি প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনে অগ্রনী ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে বিএডিসি গ্রামীন কৃষক পর্যায়ে তাদের সমন্বিত ও পরিকল্পিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার ফলে কৃষি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। যে কোন মূল্যে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ অর্জন ধরে রাখতে হবে”।
আমার বার্তা/এমই