ই-পেপার শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২

মৎস্য খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি: খাদ্যনিরাপত্তা ও রপ্তানি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

সাকিফ শামীম:
১৬ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৭

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাত একটি বহুমাত্রিক এবং অপরিহার্য স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (GDP) এই খাতের অবদান প্রায় ৩.৫৭% এবং কৃষিখাতের জিডিপিতে এর অংশ প্রায় ২৫.৩২%। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ১.৯৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের যুগান্তকারী অগ্রগতি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে স্বাদু পানিতে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং বদ্ধ পানিতে (যেমন পুকুর) মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই সম্ভাবনাময় খাতকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান চাবিকাঠি হলো আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ। গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে বায়োফ্লক, রেসওয়ে এবং খাঁচা পদ্ধতির মতো উন্নত কৌশলগুলো এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় এবং কম পানিতে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা সম্ভব। এই পদ্ধতি একদিকে যেমন পানির অপচয় কমায়, অন্যদিকে তেমনই মাছের খাদ্য খরচও সাশ্রয়ী হয়, কারণ মাছ তাদের নিজস্ব বর্জ্যকে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে, নদীতে খাঁচা পদ্ধতিতে মাছ চাষের মাধ্যমে উন্মুক্ত জলাশয়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর চাপ কমে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) ইলিশ, পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর, কইসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের কৌশল উদ্ভাবন করেছে, যা চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে এসব প্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া গেলে উৎপাদন আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

দেশের মৎস্য সম্পদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসে উন্মুক্ত জলাশয় যেমন - নদী, বিল, হাওর ও প্লাবনভূমি থেকে। এই সম্পদকে সুরক্ষিত রাখতে হলে জলাশয়ের অবৈধ দখল, দূষণ এবং অতি-আহরণ (over-fishing) বন্ধ করা আবশ্যক। মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ (The Protection and Conservation of Fish Act, 1950) কঠোরভাবে প্রয়োগ করে মাছের প্রজনন মৌসুমে বিশেষ করে ইলিশ ও অন্যান্য মা-মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করতে হবে। বর্ষাকালে জাটকা সংরক্ষণে সরকারের অভিযানগুলো প্রশংসনীয়, তবে এর ধারাবাহিকতা ও পরিধি আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। জলাশয় খনন করে এর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হলে প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণস্বরূপ, হাওর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত মৎস্য অভয়াশ্রমগুলো দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক প্রোটিন গ্রহণের প্রায় ৬০% আসে মাছ থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, অপুষ্টিজনিত সমস্যা বিশেষত শিশুদের মধ্যে ভিটামিন-এ, আয়রন এবং জিংকের অভাব পূরণে মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে সহজলভ্য হবে, ফলে পুষ্টির মান উন্নত হবে। এ লক্ষ্যে, সরকারি ভর্তুকি এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মৎস্য খাতে বিশেষ ঋণ প্রকল্প চালু করতে পারে। পাশাপাশি, মাছের পোনা ও খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ভেজাল প্রতিরোধে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

রপ্তানি খাতে মৎস্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি পণ্য। হিমায়িত চিংড়ি, ইলিশ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি করে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (EPB) এর তথ্য অনুযায়ী, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০-৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। এই আয়কে আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করতে হলে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোর কঠোর মানদণ্ড পূরণের জন্য হ্যাসাপ (HACCP) এবং বিআরসি (BRC) সার্টিফিকেশন অর্জন করা অপরিহার্য। এই লক্ষ্য পূরণে আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন এবং দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি শুঁটকি, মাছের তেল, ফিশ ফিলেট এবং অন্যান্য মূল্য সংযোজিত পণ্যের (value-added products) রপ্তানি বাজার অনুসন্ধানের মাধ্যমে পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো যেতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মৎস্য খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, বন্যা এবং খরা মৎস্য উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জলবায়ু সহনশীল ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী মাছের জাত উদ্ভাবন এবং তা চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া অপরিহার্য। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) এর বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে লবণ সহনশীল চিংড়ি, ভেটকি ও তেলাপিয়ার জাত উদ্ভাবন করেছেন। এই ধরনের গবেষণা কার্যক্রমে আরও বেশি বিনিয়োগ করা এবং ফলপ্রসূ ফলাফলগুলো মাঠ পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী সম্প্রসারণ ব্যবস্থা থাকা জরুরি।

উপসংহারে বলা যায়, মৎস্য খাতকে একটি আধুনিক ও টেকসই শিল্পে রূপান্তর করা সম্ভব হলে তা বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। সরকারি, বেসরকারি এবং মৎস্যজীবীদের সমন্বিত উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।

লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই

দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে কুয়াকাটা

বাংলাদেশের দক্ষিণে উপকূলীয় এলাকার বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে সাগরকন্যা খ্যাত পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। গরিবের

মিয়ানমারে পরাশক্তির উপস্থিতি ও আধিপত্য-বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থ সুরক্ষা

মিয়ানমার দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। একুশ শতকের উন্নয়ন ও অগ্রগতির

আধুনিক কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি

আধুনিক কৃষির জন্য প্রযুক্তি আশির্বাদস্বরূপ। বর্তমানে, পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে ফলন

ক্ষমতার পালাবদল হলেও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি অপরিবর্তিত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার পালাবদল বহুবার হয়েছে। এক সরকার গিয়েছে, আরেক সরকার এসেছে। ক্ষমতার এই
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুতিনের মাথার ওপর বি-২ বোমারু বিমান ওড়াল যুক্তরাষ্ট্র

হাতির আঘাতে আহত চিকিৎসকদের হেলিকপ্টারে আনা হলো ঢাকায়

চাঁদাবাজদের ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যুবক নিহত

ভুলে পঞ্চম রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে করণীয়

চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনে তেল পরিবহন শুরু, সাশ্রয় ৩০০ কোটি টাকা

বেনাপোলে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মুকুল হোসেন গ্রেপ্তার

বিশ্বে বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান নবম, শীর্ষে কিনশাসা

পাকিস্তানে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়াল

বিশ্ববাজারে উর্ধ্বমুখী সয়াবিন বীজ, পাম তেল ও সূর্যমুখী তেলের দাম

বনানীর সিসা বারের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে খুন হন রাব্বী: র‌্যাব

লাউ দিয়ে মুরগির ঝোল করবেন যেভাবে

গোমস্তাপুরে ২ মাদ্রাসাছাত্রীর রহস্যময় মৃত্যু

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে ফিলিস্তিনিরা পড়বে না: ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত

ছেলের জন্য ভাত নিয়ে মাদরাসায় যাওয়ার পথে বাসচাপায় বাবা নিহত

নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার রোধে কৃষি মার্কেট পরিদর্শনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোচিং সেন্টার থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

খুলনার রূপসা কৃষি ব্যাংকের ১৬ লাখ টাকা লুট

বোটসহ ১৫ জন জেলেকে উদ্ধার করল কোস্টগার্ড

চার ঘণ্টা পর চট্টগ্রামের প্লাস্টিক কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে