ই-পেপার বৃহস্পতিবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৬, ১৮ পৌষ ১৪৩২

বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান

২০২৫-এর বিশ্লেষণ
সাকিফ শামীম:
০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:০১

বর্তমান বিশ্ব এক জটিল, দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং মেরুকৃত ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের এই সন্ধিক্ষণে, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শৃঙ্খল এখন কেবল দক্ষতার বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য, প্রযুক্তিগত এবং সামরিক প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবাহকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। এই বিশাল ক্যানভাসে, এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক বিস্ময় হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু-মাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমাদের ভৌগোলিক সুবিধা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি এবং বিচক্ষণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ এই নতুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

২০২৫ সালের বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল আর শুধু 'চায়না-প্লাস-ওয়ান'-এ সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন 'ফ্রেন্ড-শোরিং' এবং 'ডাইভার্সিফিকেশন ফর রেসিলিয়েন্স'-এর মতো নতুন ধারণায় প্রবেশ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো এখন এমন অংশীদার খুঁজছে, যারা শুধু কম উৎপাদন খরচে পণ্য সরবরাহ করবে না, বরং তাদের মূল্যবোধ (Values), বিশেষ করে পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসন (ESG) মানদণ্ড মেনে চলবে।

এই পটভূমিতে, বাংলাদেশ এক অনন্য সুবিধা ভোগ করছে। আমাদের তৈরি পোশাক খাত বিগত বছরগুলোতে কমপ্লায়েন্স, কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা এবং গ্রিন ফ্যাক্টরি নির্মাণে যে বিপ্লবী অগ্রগতি এনেছে, তা বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে একটি 'বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প' হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং ইউনিসেফের সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের ইতিবাচক প্রচেষ্টার দিকে ইঙ্গিত করছে, যা পশ্চিমা বাজারগুলোর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

তবে, চ্যালেঞ্জ শুধু পোশাকে সীমাবদ্ধ নেই, উচ্চ মূল্যের এবং প্রযুক্তি নির্ভর খাতগুলোতেও এই কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা জরুরী। বিশেষ করে, হালকা প্রকৌশল, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং আইটি-এনাবলড সার্ভিসেস (ITES) খাতে স্বচ্ছতা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ড বজায় রাখার মাধ্যমেই আমরা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের আরও বড় অংশীদার হতে পারব। এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে সফল করতে ব্লকচেইন-ভিত্তিক সাপ্লাই চেইনের মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে দ্রুত বিনিয়োগ করা আবশ্যক, যা ক্রেতাদের আস্থা আরও বাড়াবে।

ভূ-রাজনৈতিকভাবে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দুই বৃহৎ পরাশক্তি চীন ও ভারত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। বঙ্গোপসাগর বিশ্ব বাণিজ্যের এক লাইফলাইন, যেখানে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, 'মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক' নিশ্চিত করতে তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।

আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখা। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) আমাদের ভৌত অবকাঠামো, বিশেষ করে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, যা লজিস্টিকসে আমাদের দুর্বলতা কাটাতে অপরিহার্য। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো সুশাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের এজেন্ডা নিয়ে বিনিয়োগের প্রস্তাব করছে, যা আমাদের রপ্তানি বাজারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো একক শক্তি বা ব্লকের প্রতি অতি-নির্ভরশীল না হয়ে প্রতিটি সম্পর্ককে জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের মানদণ্ডে বিচার করলে তা আমাদের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্র বন্দরের মতো প্রকল্পগুলোতে বহুজাতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগের এক নিরপেক্ষ কেন্দ্রে পরিণত হতে পারি। এই 'কানেক্টিভিটি হাব' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য, ছোট অর্থনীতির দেশ হিসেবে আমাদের কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক হলেও, এটি আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। প্রথমত, LDC থেকে উত্তরণের পর আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা (GSP) হারাব, যার ফলে আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৬% থেকে ১৪% পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়, সরকারকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, এবং অন্যান্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (PTA) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) নিয়ে আলোচনার সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাণিজ্য আলোচনায় বিশেষজ্ঞ দক্ষতা অর্জনের জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রতিনিয়ত কথা বলে যাচ্ছি।

দ্বিতীয়ত, মেধাস্বত্ব চুক্তি (TRIPS Agreement)-এ আমরা যে ছাড় পাচ্ছিলাম, তা বিলুপ্ত হলে আমাদের ওষুধ শিল্পের উৎপাদন খরচ বহুগুণে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ওষুধ উৎপাদনে এটি প্রভাব ফেলবে। সরকারকে ট্রিপস চুক্তির বাইরে গিয়েও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে কিছু সুবিধা ধরে রাখার জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণই একমাত্র সমাধান। আইএমএফ এবং এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে আমাদের অ্যাডভান্সড টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, অ্যাগ্রো-প্রসেসিং, মেডিকেল ডিভাইস এবং আইটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও দেশীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে প্রায় $১.৮৫ বিলিয়ন ডলারের যে বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, তার দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য 'ব্যবসা করার সহজ পরিবেশ' (Ease of Doing Business) নিশ্চিত করা এবং গ্যাস-বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাই এখন জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

তৃতীয়ত, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মূল শক্তি আসে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা থেকে। ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক সূচক, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট এবং খেলাপি ঋণের বোঝা, এগুলো দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করছে।

টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং খাতে কঠোর সংস্কার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা এবং টার্নওভার কর বৃদ্ধি-র মতো পদক্ষেপগুলো যেন ব্যবসার ওপর অতিরিক্ত চাপ না ফেলে, সেদিকে সতর্ক নজর দিতে হবে। 'বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো' ব্যবস্থার মতো উদ্যোগগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করে বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজ ও হয়রানিমুক্ত করা জরুরি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসনের প্রতি অটল অঙ্গীকার কেবল দেশীয় উদ্যোক্তাদের নয়, বরং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থানকে কেবল সুরক্ষিতই নয়, বরং সুদৃঢ় করতে পারবে।

লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই

"পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি" চুক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে আপোষহীন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক `আপোষহীন' নেতৃত্বের নাম।রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত তিনি

শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্য: ১-১২তম ব্যাচের নিবন্ধিতদের ন্যায়বিচার দাবি

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন এক অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)

শিক্ষা-শিল্প ফাঁক কমাতে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গত এক দশকে বিস্তারের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা

হাদির ওপর হামলা, শান্তির পথে কাঁটা ছড়াচ্ছে কারা?

বহু প্রতীক্ষা ছিল। নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছিল দেশ। নির্বাচন কমিশন ‘তফসিল’ ঘোষণা করল। নির্বাচনের ট্রেন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসান আর নেই

খালেদা জিয়ার জানাজায় তারেক রহমানকে সান্ত্বনা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার জানাজা, গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ

জানাজায় বিপুল জনসমাগম মৃতের জন্য যে সৌভাগ্য বয়ে আনে

রাষ্ট্রীয় শোকে রাজধানীতে আতশবাজি-সব ধরনের উৎসব নিষিদ্ধ: ডিএমপি

মাকে কবরে রেখে বিষণ্ন মনে বাসায় ফিরলেন তারেক রহমান

নতুন বছরে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বেগবান হবে: আশা প্রধান উপদেষ্টার

ভারতে চলন্ত ভ্যানে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ২ ঘণ্টা পর রাস্তায় নিক্ষেপ

পোস্টাল ভোট দিতে ১১ লাখ নিবন্ধন, ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়াল ইসি

খালেদা জিয়া স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে ছিলেন: আনিসুল ইসলাম

মধুপুরে যানজট নিরসনে প্রশাসনের মতবিনিময় সভা

"পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি" চুক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে আপোষহীন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া

সম্পর্ক উন্নয়নে খালেদা জিয়ার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে: চীনা মুখপাত্র

ডাকাতির গরু বাঁচাতে ক্যাভার্ড ভ্যানে অক্সিজেন রাখতেন ডাকাত

কথা রাখলেন খালেদা জিয়া, দেশের মাটিতে স্বামীর পাশে চিরনিদ্রায়

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে ছবি-ভিডিও বানাবেন যেভাবে

জানাজায় অংশ নিতে আসা বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে উপদেষ্টাদের সাক্ষাৎ

সিলেট স্টেডিয়ামে খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া অনুষ্ঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় ৫০ প্লাটুন আনসার ও টিডিপি মোতায়েন

খালেদা জিয়ার জানাজায় পদদলিত হয়ে একজনের মৃত্যু