প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে হতাশ হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বলে জানিয়েছে দলটি।
বুধবার (৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মগবাজারে অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে দলের এ অবস্থান তুলে ধরেন নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ সময় তার সঙ্গে দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ নির্বাহী পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
‘আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে’
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় গতকাল ৫ আগস্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাপত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি। এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কথা বলা হলেও ১৯৪৭ এর আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী এবং অনলাইন এক্টিভিস্টদের ভূমিকার উল্লেখ নেই; যা ইতিহাসের প্রতি অবিচার ও অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা, যা এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছিল; সে বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’
জামায়াত মনে করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এ জন্য ৬টি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দুই পর্বের দুই মাসেরও অধিক কাল যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই।
তাহের বলেন, ‘ঘোষণায় কখন, কীভাবে তা কার্যকর করা হবে তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।’
‘প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি’
ডা. তাহের বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও ইনসাফভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্বাচনের টাইমলাইন (ডিসেম্বর-জুন) শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। তা না করায় জাতি হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার দীর্ঘদিনের যে ঐতিহ্য তা উপেক্ষা করে জুলাই ঘোষণার দিনেই নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপি জাতীয় স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।’
‘ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি দিতে বাধা কোথায়’
ডা. তাহের বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে সব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনি প্রস্তুতি চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল, তা সরকার এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে।’
‘অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে- পরবর্তী সময়ে তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্কের ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল’, বলেন তাহের।
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ১০ মাস মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ ও দেশ পরিচালনা, দল গঠন, সামরিক প্রশাসক থেকে প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণসহ ৭৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত শাসনকালের গণভোট, অধ্যাদেশ জারি করে তার ক্ষমতায় আরোহন ও দেশ পরিচালনার মতো বৈধতা দিয়েছিল, যা পরবর্তী সংসদ অনুমোদন করে।’
‘উপরন্তু ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তার আইনি ভিত্তি না থাকায় এ রূপরেখার অন্যান্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। অতীতে এত নজির থাকার পরও এখন জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি দিতে বাধা কোথায়?’
জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের আকাঙ্ক্ষা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোট এর মাধ্যমে আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।’
আমার বার্তা/জেএইচ